ভাষার কারণেই মানুষ অন্য সব প্রাণী থেকে ভিন্ন মর্যাদার অধিকারী। ভাষা হলো চিন্তার বাহন। মানুষ যা চিন্তা করে সেসব চিন্তা ও অনুভূতি ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করে। আর অসংখ্য ভাষার ভেতর প্রত্যেক মানুষের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তার মাতৃভাষা। জন্মের পর পর যে ভাষা সে তার আশপাশে শুনতে পায়, তার মায়ের মুখ থেকে শুনতে পায়; তাই হলো মাতৃভাষা।
ভাষাই মানুষকে অন্য প্রাণী থেকে আলাদা করেছে। কল্পনা আর অনুভূতিকে অক্ষরের অসীম বিন্যাসে সাজাতে পারার সক্ষমতা অকিঞ্চিৎকর প্রাণীটিকে দিয়েছে দুনিয়া তছনছ করে ফেলার শক্তি। ফলে ভাষার বিকাশ এবং মানুষের সভ্যতার বিকাশ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। শুরুতে সঠিক শব্দ খুঁজে বেড়ানোর যে আলাপ তা এ কারণে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বোঝাপড়া, দুনিয়ার নানা বিষয়ের সঙ্গে তার যোগসাজশেই শব্দের জন্ম হয় আর এর চর্চা একে শানিত করে। নানা এলাকার মানুষ যেমন বৈচিত্রপূর্ণ বৈশিষ্ট্যর অধিকারী হয়, ভাষাও সেভাবেই গড়ে ওঠে। যেমন বলা হয়, এস্কিমোরা নাকি নানা ধরনের বরফ ব্যবহারে অন্তত ৪০ ধরনের শব্দ ব্যবহার করেন। বরফের গড়ন, রঙ, ধারণক্ষমতাসহ নানা বৈশিষ্ট্যে এ ভাগ হয়। আমরা যারা জীবনে বরফই দেখিনি, তাদের কাছে এ ব্যাপারটা কল্পনা করাও কঠিন। অন্যদিকে, এস্কিমোরা এত এত শব্দ ব্যবহার করলেও শুধু ‘বরফ’ বলার জন্য কোনো আলাদা শব্দ ব্যবহার করে না। কারণ বরফ তাদের জীবনের এতটাই অবিচ্ছেদ্য অংশ যে, সে আলাদা করে এর নাম না দিয়ে এর নানা বৈচিত্রকে নাম দিয়ে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছে।
ঠিক একইরকম ব্যাপার আমরা দেখতে পাই বৃক্ষের বেলায়, প্রাণীর বেলায়। আমরা যারা বৃক্ষ বিশারদ নই, তারা শয়ে শয়ে পদের বট কিংবা তালজাতীয় গাছের পার্থক্য বুঝব না। আমাদের চোখে যেখানে সব কুকুরই শুধু কুকুর, যারা চেনে-জানে তারা ডোবারম্যান, শেফার্ড, বুলডগ, রিট্রিভিয়ার, টেরিয়ার এরকম শয়ে শয়ে প্রকার আলাদা করে চিনতে পারেন। আদতে প্রজাতির নামকরণের যে শাখা তা আধুনিক জীববিজ্ঞানের ভিত্তি। এর ওপর ভিত্তি করেই বিজ্ঞান এগিয়ে যায়। ব্যাপারটি যে আধুনিক তাও নয়। আমরা যদি আদিম মানুষের জীবন চিন্তা করি, তবে দেখব, তাদের কাছে এ ব্যাপারটি ছিল একদমই জীবনমরণের। কোন ফলটি সুস্বাদু, কোন ফলটি বিষাক্ত, কোনটি কোন মৌসুমে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়, এসবের ওপর ভিত্তি করে তারা খাবার সংগ্রহ করতেন। এর সঙ্গে যদি যুক্ত করি বিভিন্ন প্রাণীর নাম, কোনটি বিপজ্জনক, কোনটি শিকারযোগ্য আর জায়গার নাম সেসব জায়গায় বৈশিষ্ট্যর নাম। এ শ্রেণিবিভাগ আদিম মানুষের একদম প্রাথমিক প্রয়োজনীয়তা ছিল। এ জ্ঞান ছিল জীবনধারণের জন্য সবচেয়ে জরুরি। বিজ্ঞানীরা বলেন, আদিম মানুষের যে মেন্টাল ম্যাপিং, তা আধুনিক যুগের মানুষের চেয়েও অনেক বেশি বিস্তৃত। এ চর্চা তার মস্তিষ্ককে সমৃদ্ধ করেছে। মস্তিস্ক নিয়ে কাজ করা বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখান যে, বহুভাষাবিদদের বুড়ো বয়সে ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রম হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়। বহুভাষার চর্চা মানুষের মস্তিষ্ককে উদ্দীপ্ত ও ক্ষুরধার করে। প্রকৃতির কথা তো বলাই হলো। মানুষ তো দিনশেষে প্রকৃতিরই অংশ। আর ক্রমেই দুনিয়া দখলের নেশায় আমরা যে আমাদের জানামতে একমাত্র বাসযোগ্য দুনিয়াকে ক্রমেই ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছি, তা ঠেকাতে নিজেদের পরিবেশের অংশ ভাবা জরুরি। পরিবেশকে দূরের কিছু ভাবলে ধ্বংস অনিবার্য। এ কারণে প্রকৃতির উপাদানগুলোকে চিনতে হবে, জানতে হবে। ভাষার গুরুত্ব এখানে অপরিসীম। সত্যজিৎ রায়ের আগন্তুক সিনেমায় আমরা দেখি, প্রোটাগনিস্ট মনোমোহন মিত্র এক তর্কে উত্তেজিত হয়ে বলেন, আদিবাসীদের ভাষা আর সংস্কৃতি সুরক্ষা করা কেবল আমাদের জন্য কোনো রোমান্টিক বিষয় নয়। আমরা যাদের ‘অসভ্য’ বলি, তাদের ভাষায় কেবল যে প্রাচীন জ্ঞান লুকানো তাই নয়, এতে আছে আধুনিক বিজ্ঞানেরও সূত্র। একেকটি ভাষা হারিয়ে যাওয়া মানে আমাদের বিজ্ঞানের একটা অংশ খসে যাওয়া।
শুধু পরিবেশ নয়, এমনকি প্রযুক্তির উৎকর্ষের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষায়। কারণটা সহজেই বোঝা যায়। একেক এলাকায় প্রাকৃতিক বৈচিত্রের কারণে একেক এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন ভাষা গড়ে উঠেছে। এস্কিমোদের উদাহরণ থেকেই বলা যায়, প্রকৃতিকে ঠিকঠাকভাবে বুঝতে, ভূমির অভ্যন্তরে ও ওপরে লুকিয়ে থাকা অসীম শক্তি ব্যবহার করতে স্থানীয় ভাষা হাজারে হাজারে শব্দ তৈরি করেছে। এ ভাষাগুলোর হারিয়ে যাওয়া আমাদের ভবিষ্যতের জন্য বিপদ। মুশকিল হচ্ছে, বিশ্বায়নের দুনিয়ায় আমরা যোগাযোগের সুবিধার্থে একক ভাষার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছি। ক্রমেই ইংরেজি হয়ে উঠছে একমাত্র ভাষা। ইংরেজি ভাষা নিয়ে লেখা পন্ডিত ডেভিড ক্রিস্টাল নিজেও এ ব্যাপারটি মানুষের সভ্যতার জন্য বিপজ্জনক ভাবেন। আবার একই সঙ্গে তিনি দেখান নামে ইংরেজি হলেও এ ভাষাটি বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে। দিনশেষে যতই প্রতাপ থাক, ভাষা যদি নমনীয় না হয়, তবে তার জন্য টিকে থাকা কঠিন। এর বড় উদাহরণ লাতিন, সংস্কৃত। শুধু কি তাই, ইংরেজির নিজের যাত্রাটাই দারুণ। একসময় শাসকগোষ্ঠীর ভাষার চাপে প্রায় হারিয়ে যাওয়া ভাষাই এখন পৃথিবীর লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা হয়ে উঠেছে। মেলভিন ব্র্যাগের দি অ্যাডভেঞ্চার অব ইংলিশ ডকুমেন্টারি এবং একই নামের বইটিতে এ ইতিহাসের দারুণ বিবরণ পাওয়া যায়।
একক ভাষা হয়ে ওঠার পেছনে আছে ভাষা নিয়ে রাজনীতি। ভাষাকে ব্যবহার করে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টাটা অনেক পুরনো। লোকরঞ্জনবাদের এ সময়ে আমরা দেখি এই চেষ্টাটা আরও বিপজ্জনক হতে। এর প্রতিরোধ নিয়ে সবচেয়ে গর্বের ব্যাপারটা তো আমাদেরই। আমরা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি। ভাষা চাপিয়ে দেয়ার যে আধিপত্যবাদ তা রুখে দিয়েছি। এ আন্দোলন ছিল আমাদের মুক্তির, নিজেদের দেশ পাওয়ার মূল ভিত্তি। ডেভিড বিভার আর জেসন স্ট্যানলির সুলিখিত বই দ্য পলিটিকস অব ল্যঠঙ্গুয়েজে এ নিয়ে বিশদ জানা যায়। আর এ শতকে এসে আমরা এ আন্দোলনকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি বৈশ্বিকভাবে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ব্যাপারটা শুধুই একটি দিবস নয়, বরং আমাদের অস্তিত্বের জন্য জরুরি। অন্য ভাষাকে দমন করে, নির্দিষ্ট একটা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা শুধুই যে ওই ভাষাটিকে হত্যা করে, আমাদের জ্ঞানের আধার ধ্বংস করে তাই না; এর অন্য একটা ভয়াবহ দিক আছে।
ভাষাকে দমনের মাধ্যমে, ভাষাকে অবজ্ঞা করার মাধ্যমে আমরা নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীকেও ‘আদার’ করে রাখি। তাদের প্রকারান্তরের নিচু শ্রেণির বলে সূক্ষ ও স্থূলচর্চা করি। পাকিস্তানিদের ঠিক এ উদ্দেশ্যই ছিল। শুধু তাই নয়, অন্য ভাষা না বুঝলে আমরা সেসব মানুষকেও বুঝব না। লোকরঞ্জনবাদী শাসকরা ঠিক তাই চায়। তারা চায় এক জাতি, এক বিশ্বাসের মানুষ অন্যদের ওপর আধিপত্য করুক। এ রাজনীতি ঠেকাতে আমাদের ভাষার বৈচিত্র সংরক্ষণ করতে হবে।
আমাদের ভাষা আন্দোলনের শিক্ষা হচ্ছে, আমরা অন্য ভাষার ওপর আধিপত্য করব না। আমরা দেখছি পাশের দেশে বিপজ্জনকভাবে হিন্দিকরণ করার চেষ্টা হচ্ছে। এর ঢেউ আমাদের ওপরও পড়ছে। সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যের বিপুল আগ্রাসনের এ ঢেউ ঠেকানো কঠিন। সন্দেহ নেই, লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা হয়ে ওঠা ইংরেজি আমাদের জন্য জরুরি। এমনকি হিন্দিও শিখতে হবে। ক্রমেই আবারও দুই মেরুতে বিভক্ত হওয়া দুনিয়ায় মান্দারিনের গুরুত্ব বাড়ছে। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশে, বৈশ্বিক ভাষা আরবিও খুব জরুরি। আমাদের কোনো ভাষার সঙ্গে সংঘাত নেই, লড়াই ভাষাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে। সংখ্যালঘুদের কোণঠাসা করার ব্যাপারে। ঠিক একইরকমভাবে খেয়াল রাখতে হবে, বাংলার চাপে আমাদের দেশে থাকা অসংখ্য ভাষা যাতে বিলীন হয়ে না যায়। ভাষার বৈচিত্র রক্ষা লাখো লাখো বছরের সভ্যতার যাত্রা শুধু নয়, আমাদের ভবিষ্যৎ রক্ষা করার জন্যও জরুরি।
ইসলামি বিশ্বাস মতে প্রতিটি ভাষাই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সৃষ্টি, ভাষার বৈচিত্র আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, দয়াময় আল্লাহ, তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন, তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে। (সূরা: আর-রাহমান, আয়াত: ১-৪)। বাংলা, আরবি, ফার্সি, হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মানি, পর্তুগিজ, চাইনিজ, জাপানিজ, কোরিয়ান, রুশ প্রতিটি ভাষাই আল্লাহর পক্ষ থেকে। মানব ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে অসংখ্য জাতি আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেক জাতির নিজস্ব ভাষা ছিল। প্রত্যেক জাতির কাছে নবী রাসূল এসেছেন। আল্লাহ সেই নবীদের তাদের স্বজাতির ভাষায় প্রেরণ করেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাসি করে পাঠিয়েছি তাদের নিকট পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করবার জন্য, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’। (সূরা: ইব্রাহিম, আয়াত: ৪)
আরবি ভাষাকে আমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষা জানি। কারণ আরবি ভাষায় পবিত্র কোরআন নাযিল হয়েছে। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে আমাদের নবীজি (সা.) এর আগে অন্য নবীদের আরবি ভাষাভাষি করে পাঠানো হয়নি। মুসা (আ.) এর ভাষা ছিল হিব্রু, ইসা (আ.) এর ভাষা ছিল এরামিক। প্রত্যেক নবীকে তার স্বজাতির ভাষায় আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহি তথা প্রত্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে মানুষ তার মাতৃভাষায় আল্লাহর কথা যত সহজে বুঝতে পারবে অন্য ভাষায় সেভাবে হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব নয়। এজন্যই আল্লাহ তাআলা সূরা ইব্রাহিমে এই ঘোষণা দিয়েছেন। এ থেকেই মাতৃভাষার গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়।
ভাষিক দক্ষতার গুরুত্ব সম্পর্কে কোরআন হাদিসে অনেক ভাষ্য আছে। নিজের ভাষায় পারদর্শিতা যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা উপলব্ধি করতে পারি মুসা ও হারুন (আ.) এর ঘটনা থেকে। আল্লাহ তাআলা যখন মুসা (আ.)-কে নবী হিসেবে মনোনীত করলেন তখন মুসা (আ.) তার আপন বড় ভাই হারুনকে তার সহকারী নবী হিসেবে মনোনীত করার আবেদন করেন। মুসা (আ.) এই আবেদনের কারণ হিসেবে বলেন, হারুনের ভাষা অধিক স্পষ্ট। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমার ভাই হারুন আমার চেয়ে অধিক বাগ্মী, অতএব তাকে আমার সাহায্যকারীরূপে প্রেরণ করুন, সে আমাকে সমর্থন করবে’। (সূরা: কাসাস, আয়াত: ৩৪)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তখন মুসা বললো, হে আমার প্রতিপালক, আমি আশঙ্কা করি যে, তারা আমাকে অস্বীকার করবে এবং আমার হৃদয় সংকুচিত হয়ে পড়ছে, আর আমার জিহবা তো সাবলীল নয়, সুতরাং হারুনের প্রতিও প্রত্যাদেশ পাঠান’। (সূরা: শুআরা, আয়াত: ১২-১৩)। এ কারণেই পবিত্র কোরআনে সূরা রূমের ২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “এবং তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।”
আমাদের নবী মোহাম্মাদ (সা.) পৃথিবীতে মানব জাতির শেষ নবী। এই যুগটা জ্ঞান বিজ্ঞানের যুগ। ভাষার মাধ্যমেই মানুষ জ্ঞান বিজ্ঞানে উৎকর্ষ লাভ করে। তাই আমাদের নবীজি (সা.) এর মুজেযা দেয়া হয় ভাষা কেন্দ্রিক। পবিত্র কোরআনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর ভাষা সাহিত্য ও অলংকার। কোরআন যাদের জন্য নাযিল হয়েছে তাদেরও ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
হাদিস শরিফেও আমরা লক্ষ করি , সাহাবিদের দৈনন্দিন কাজকর্মেও রাসূলুল্লাহ (সা.) ভাষার বিশুদ্ধতা, উপযুক্ত শব্দচয়ন ইত্যাদির প্রতি তাগিদ করেছেন। একবার জনৈক সাহাবি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে আসলেন। তিনি বাইরে থেকে সালাম দিয়ে বললেন, ‘আ-আলিজু?’ প্রবেশ করা অর্থে এই শব্দের ব্যবহার আরবি ভাষায় ব্যবহার হয়। কিন্তু অনুমতি কিংবা প্রার্থনার ক্ষেত্রে তা প্রমিত শব্দ নয়। প্রমিত শব্দ হচ্ছে ‘আ-আদখুলু?’ তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি ‘আ-আদখুলু’ বলো। রাসূলুল্লাহ (সা.) এভাবে তার শব্দপ্রয়োগ ঠিক করেছেন। অথচ তা যিকির-আযকার বা এ জাতীয় কোনো কিছু ছিল না। সহিহ মুসলিম শরিফে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ই আছে ‘কিতাবুল আলফায’ নামীয় শিরোনামে। সেখানে বিভিন্ন হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) শব্দপ্রয়োগ সংশোধন করেছেন। ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা এশার নামাজকে ‘আতামা’ বলো না, বরং ‘এশা’ বলো’। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমরা ‘আঙুরকে’ ‘করম’ বলো না, ‘ইনাব’ বলো’। আমাদের বিশেষ ভাবে মনে রাখতে হবে যে, কোনো ভাষাকে হেয় করে দেখা ঠিক নয়। বিশেষত মাতৃভাষাকে প্রত্যেক মুসলিমের গুরুত্ব দেয়া উচিত। ঠিকঠাক মাতৃভাষা চর্চা না করলে মেধা পূর্ণ বিকশিত হবে না। শুধু কি তাই নিজের ভাষা আয়ত্ব না হলে আল্লাহর কাছে প্রাণ খুলে চাইতে পারবে না এবং হৃদয়ের সুকোমল বৃত্তিগুলোর বিকাশও ঘটবে না।
এ কারণে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের নতুন এক চেতনা ও মূল্যবোধের জন্ম দেয়। বুঝেছিলাম জাতি হিসেবে আমাদের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষার মর্যাদা আদায়। ভাষা কৃষ্টি প্রত্যেক জাতির প্রকৃষ্ট সম্পদ। আর তাই আমাদের এই মাতৃভাষার ওপর শত্রুরা যখন আক্রমণ চালায় তখন আমরা রুখে দাঁড়াই। যেহেতু ভাষা বা সংস্কৃতি থেকে পৃথক হয়ে জাতি হিসেবে আমাদের কোনো অস্তিত্ব ভাবা সম্ভবপর ছিল না, সেহেতু আমরা ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রের স্বাধিকার আদায়ের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হই। তৎকালীন সমাজে বাঙালিরা রাজনৈতিক চেতনায় প্রখর ছিল না। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি তাদের সে মহামন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে। ভাষার স্বাধিকার আদায় থেকে শুরু করে একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবি আমরা তাই পরবর্তীকালে করি। আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনা কতখানি প্রখরতা লাভ করলে আমরা এতখানি পথ পরিক্রমের স্বপ্ন দেখি এবং পথ পাড়িও দেই তার মর্ম উপলব্ধির মধ্যে একুশের চেতনার মাহাত্ম নিহিত।
লেখক : এম এ কবীর, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি।
Leave a Reply